ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে দেশী বিদেশী অনেক ঐতিহাসিক বিভিন্ন প্রকার অভিমত ও মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। এসব প্রদত্ত অভিমত ও মতবাদের মধ্যে বর্ণিত পাঁচটি অভিমত পরস্পর সমার্থক বিধায় অতিশয় প্রণিধানযোগ্য।
প্রথম অভিমত :শ্রীশ্রী রাজামালা মতে, ভারত বর্ষের ইতিহাসে রাজা যযাতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি প্রতিষ্ঠান নগরের রাজা ছিলেন। চন্দ্রবংশীয় এই রাজার দুই স্ত্রী। দেব্যানী ও শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর গর্ভে দুইপুত্র যদু ও তুর্বসু। শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পুত্র দ্রুহ্য, অনু ও পুরু। এই পাঁচ পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ব্যতীত বাকী চারজন পুত্র পিতার অবাধ্য ছিলেন।
কথিত আছে, রাজা যযাতি ঋষিকন্যা শর্মিষ্ঠাকে গোপনে বিবাহ করার অপরাধে ঋষি শুক্র কর্তৃক জরাব্যাধিতে অভিশপ্ত হন। এর একমাত্র প্রতিকার ছিল কেউ যদি স্বেচ্ছায় জরাব্যাধি গ্রহণ করে, তবে তাঁর মুক্তি। রাজা যযাতি অতিশয় ভোগবিলাস এর প্রতি আসক্ত ছিলেন।
ফলে তিনি পুত্রদের ডেকে তাঁর অভিশপ্ত জরাব্যাধি গ্রহণ করার কথা বললেন। পিতার অভিপ্রায় জেনে সর্ব কনিষ্ঠ পুরু ব্যতীত বাকী চারপুত্র কঠোরভাবে পিতাকে তিরস্কার করলেন।
পুরু পিতার জরাব্যাধি গ্রহণ করেন। পুত্রদের অবাধ্যতা দেখে ক্ষুব্ধ যযাতি পুরুকে প্রতিষ্ঠান নগরের রাজ্যভার অর্পণ করেন এবং বাকী চার পুত্রকে স্বীয় রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেন।
তৃতীয় পুত্র দ্ৰহ্য নির্বাসিত হন প্রতিষ্ঠান নগরের উত্তরপূর্ব প্রান্তর সমুদ্র ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থল সগরদ্বীপে। তিনি অতিশয় মহাবলী ছিলেন। তিনি সগরদ্বীপ থেকে কপিলা নদীর তীর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে ত্রিবেগ নামে রাজ্যপাট প্রতিষ্ঠা করেন।
রাজ মালায় বর্ণিত আছে :
ত্রিবেগ স্থলেতে দ্রুহ্য নগর করিল।
কপিলা নদীর তীরে রাজ্যপাট ছিল ॥
----- দ্রুহ্যখণ্ড ।
রাজা দ্রুহ্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দৈত্য ত্রিবেগ নগরের রাজা হন। তিনি প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। রাজমালায় বর্ণিত আছে ......
দ্রুহ্য বংশে দৈত্য ত্রিবেগ নগর
অনেক সহস্রবর্ষ হইল অমর ॥
বহুকাল পরে তান পুত্ৰ উপজিল
ত্রিবেগ জন্ম নাম ত্রিপুরা রাখিল ॥
----- দৈত্য খণ্ড।
দৈত্য রাজার পুত্রের নাম ত্রিপুর। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ত্রিবেগ নগরের রাজা হন। তিনি অতিশয় অত্যাচারী দেবদ্রোহী ও মহাপরাক্রমশালী ছিলেন। এই রাজা ত্রিবেগ নগর থেকে আরো উত্তরপূর্বে ধাবিত হয়ে কিরাত ভূমি অধিকার করেন এবং ত্রিবেগ ও কিরাতগণের মধ্যে মহামিলন ঘটান।
ত্রিপুর রাজা তাঁর বিজিত রাজ্যের নামকরণ করেন ত্রিপুরা এবং স্বীয় প্রজাদের ত্রিপুরাজাতি বলে প্রচার করেন। রাজা ত্রিপুরের মহিষীর নাম হীরাবতী।
দ্বিতীয় অভিমত : বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখ আছে ভারত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তরে কিরাতের বাস। কামরূপ (আসাম) ও রাক্ষ্যং (আরাকান) দেশের মধ্যবর্তী স্থানকে প্রাচীন আর্যগণ কিরাত (সুক্ষ) নামে আখ্যায়িত করেন। লৌহিত বংশীয় মানবগণ সেখানে রাজ্যপাট গড়ে তুলেছিলেন। এই ভূখণ্ডটিই মহাভারতের যুগে ত্রৈপুরা কখনও বা ত্রৈপুরী নামে আখ্যায়িত হয়। ত্রৈপুরা বা ত্রৈপুরী থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি। মহাভারতের ৫১ পীঠের মধ্যে ত্রিপুরা একটি। পীঠমালা তন্ত্র এক পঞ্চাশৎ বিদ্যোৎ পংক্তিতে বলা হয়েছে
ত্রিপুরায়াং দক্ষপাদো দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী।
ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বাভীষ্ট ফলপ্রদ।
তৃতীয় অভিমতঃ
হীরাবতীর পুত্র নাম ত্রিলোচন রাজা।
দিব্যকান্তি সৌম্য পুরুষ হএ মহাতেজা ॥
ত্রিলোচন ঘরে বারপুত্র উপজিল।
বারঘর ত্রিপুরা নাম তার খ্যাতি হৈল ॥
রাজবংশ ত্রিপুরা সে রাজা হৈতে পারে।
ত্রিপুরা রাজ্যতে ছত্র অন্য নাহি ধরে।
দৈবগতি রাজার না হএ যদি পুত্র।
তবে রাজা হৈতে পারে ত্রিপুরের সূত্র ।।
--- ত্রিলোচন খণ্ড।
চতুর্থ অভিমতঃ ত্রিপুরা নামের সঙ্গে ককবরক ভাষায় দুটি শব্দ জড়িত আছে। ত্রিপুরাগণ যে ভাষায় কথা বলে তা ভারতবর্ষে ককবরক নামে পরিচিত। ককবরকে তোয় শব্দের বাংলা অর্থ হয় জল বা নদী। আর প্রা শব্দের বাংলা অর্থ হয়: সংযোগস্থল বা মাহোনা। অর্থাৎ তোয়প্রা নামে ত্রিনদীর মাহোনাস্থল। ত্রিপুরাগণের সাধারণ বিশ্বাস একসময় তাদের পূর্বপুরুষগণ সাগর সঙ্গম স্থল গঙ্গানদীর অববাহিকায় রাজপাট গড়েছিলেন এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে সম্প্রসারিত হয়েছিলেন।আইতরমা গ্রন্থে ত্রিপুরা নামক কাব্য রচনায় উল্লেখ আছে;
ব্ৰহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী হিনৈ।
তোয় সুকথামনি বপ্রাঅৗ রাজধানী তেয়ৈ ॥
ত্রিপুরানী আদি রাজা প্রজারকনৗ লাগৈ।
রাজ্য শাসন খায়ৈ থাংখা আনন্দ খায়ৈ ॥
তোয়প্রাঅৗ তংখা হিনৈ তিপ্রা হিনজাকখা
তোয়প্রানি ত্রিপুরা মুং উলো অংগৈ থাংখা ॥
উল্লিখিত উদ্ধৃতি এবং ঐতিহসিক রাজ্য ও জাতির প্রতিষ্ঠাতা আদি পিতা ছিলেন রাজা ত্রিলোচন এবং তিনিই ত্রিপুরা জাতির সিবরাই।
পঞ্চম অভিমত : ঐতিহাসিকগণের সর্বজন স্বীকৃত অভিমত যে, রোসাঙ ( আরাকান ), চট্টল ( চট্টগ্রাম ) ও কমলাস্ক ( কুমিল্লা ) এ তিনটি অঞ্চল নিয়ে প্রাচীনকালে ত্রিপুরা রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এ তিনটি অঞ্চলে তিনটি পুর ( নগর ) ছিল এবং নগরগুলি নদীতীরে অবস্থিত ছিল। ফলে এ তিনটি পুরের অধিবাসীগণকে ইতিহাসে ত্রিপুরা নামে অভিহিত করা হয়েছিলো।
( ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি )