বসন্ত শেষ হইবার কাছাকাছি। চারিদিকে কোকিলের মধুর বীণার সুরে পরিবেশটা যেন জোৎস্নার আলোতে দীপ্তিমান। গগণে কোকিল ও ভূমিতে মনুষ্যের আনন্দে নাচানাচি ।আমি উঁচু টিলার উপর একলা বসিয়া আছি । বৈসুর উৎসবের লাগি হাওড়-বিলের অম্বু ছাড়াছাড়ি , ইহাতে মাছ , চিংড়ি , কাঁকড়া ধরিতে অবিরত লোকের ছোটাছুটি । কি করিব ? আমিও কি তাহাদের পিছে ছুটে চলি? ভাবিয়া কুলাইনা আর! এদিকে বৈসু ঘনিয়া আসিতেছে । আমি আর মা ছাড়া ঘরে কিছুই নাই । গ্রামীণ পরিবেশ ; কোনো পূজা , উৎসব অনুষ্ঠিত হইলে যুব-যুবতী আনন্দে মেতিয়া উঠে । তেমনি বৈসুর দিবা আগে গ্রামের যুব-যুবতীরা জঙ্গলে বাহির হইয়াছে কেউ শাকসবজি খোঁজে , আবার কেউ ক্ষুদ্র ছড়া হইতে মাছ ধরিবে । তাহাদের উৎসব দেখিয়া মোর হৃদয়খানি করিতেছি আনচান । এক পা দু'পা করিয়া বাডড়ির উদ্দেশ্যে চলিলাম । আমিও কি তাহাদের পিছু নিতে থাকিব না নিব না! আনমনে পৌছিলাম বাড়িতে , মা! মা! ডাক দিলাম । কিন্তু কোনো উত্তর নেই! দরজা খুলে দেখি মা ঘুমিয়াছে । দরজা খোলার আওয়াজে মা'র ঘুম ভাঙ্গলো। বলিলাম মাছ , শাকসবজি খোঁজতে বনে যাইতেছি । মা কহিল যাহ্ ! বাবা । একটা থালা ও বাবার রেখে যাওয়া মাছ ধরার পুরনো ভাঙাচুরা লুসি হাতে নিয়ে বের হলাম । আমিও মনে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করিয়া চলিতে লাগিলাম । কিন্তু তাঁহারা ভালো মানের সামগ্রীগুলো আমার জন্য রেখে যাওয়ার পাত্র নয় । তাহাদের উচ্ছিষ্ট পথের প্রান্তে ফেলে দেওয়া শুঁটকি মাছ, চিংড়ি , কাঁকড়া কুড়িয়ে নিতে থাকিলাম । যাহা পাইতাম তাহা কুড়িয়ে নিতাম । অবধি চলিতে চলিতে পাশে একটি সাপ ছটফট করিতে দেখিতে পাইলাম । ভাবিলাম এই সাপের কি হইয়াছে? সুস্থ সাপ হইলে জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করার কথা ছিল না । তাহার গায়ে ছিল ক্ষতের চিহ্ন । অযথা তাহার গায়ে আঘাত ও ক্ষতের চিহ্ন থাকিবার কথা না ! নিশ্চয়ই আগে যারা গিয়েছিল ইহা তাহাদের কান্ড হইতে পারে । তাড়াহুড়ো করিয়া কিছু বনজ ঔষধি গাছের পাতা গুঁড়ো করে পরনের গামছাটা ছিঁড়ে ক্ষতের ওপর ঔষধটা লাগিয়ে দিয়ে চলিয়া গেলাম । যাহা পেয়েছি ইহা লইয়া বাড়িতে রওনা দিলাম । উৎসবমুখর গ্রামটা হাসি খুশিতে ভরে উঠল । কিন্তু আমাকে সঙ্গ নিবে কে? কোনো রকমে বৈসুর উৎসবটা উপভোগ করিলাম । এদিকে মাসটা বৈশাখে পর্দাপণ করিল । আকাশের চারদিকে গুরুম গুরুম আওয়াজ । মনে হচ্ছে যেন আকাশটা এক্ষুণি মাথার উপর ভেঙে পড়িবে । হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে পড়ল সাপটির কথা । একটি আহত সাপকে ঔষধ লাগাইয়া চলিয়া এসেছিলাম । সাপটির অবস্থা কেমন হইয়াছে ! মরে গেছে নাকি বেঁচে উঠিয়াছে! সাপকে ফেলে আসা জায়গায় চলিলাম । কিন্তু দূর থেকে যাহা দেখিলাম যেন আমি আর ভুবনে নেই । কেন তাহাকে দেখিতে আসিলাম? যেভাবে কাল নাগিনীর মতো রাগান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাছে পেলেই আমাকে ছোবল দিয়া মেরে ফেলিবে! অবশেষে সাপটি নিজেই আমাকে কথা জিজ্ঞেস করিল । কেমন আছেন! বন্ধু। মনে মনে বলি এ কি সাপকে ও দেখি কথা বলিতে পারে । কহিলাম - হ্যাঁ । ভয় পেয়োনা ! আমি আপনাকে প্রহার করিতে যাব কেন? আমিও আপনার বন্ধু । কেননা আপনি আমার জীবন রক্ষা করিয়েছেন । সেদিন আপনি আমার জীবন রক্ষা না করিলে এতক্ষণে হয়তো আমি গলে , পঁচে যাইতাম । কতদিন হইলো আপনার অপেক্ষায় এখানে বসিয়া আছি । কিন্তু আপনার কোনো খবর নেই । যাক জীবনদাতা মনুষ্যকে দেখতে পেয়ে মোর হৃদয়খানি খুব খুশি হইয়াছে। জানো বন্ধু ! মনুষ্যের হাসি , আনন্দ ধ্বনি শুনে আমি জঙ্গল হইতে উঁকি দিয়ে দেখি এক যুবতী মেয়ে আমাকে প্রহার করে । ইহাতে আমি ছটফট করতে করতে পড়ে রহিলাম । নারীরা সাথে কি সাপের শত্রুতা আছে? এই দুঃসময়ে পাশে থেকে আপনি যে মানবিকতার দিয়াছেন ইহা মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হৃদয়ে গাঁথা থাকিবে । এই সুসময়ে আমি আপনার জন্য কি করিতে পারি,? বন্ধু । আমার আবার কি লাগিবে ! মা ও আমি সুস্থ জীবনযাপন করিতে পারাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । আর আপনাকে বিপদের সময় সাহায্য করা আমার কতব্য ছিল । ইহা আমার মাতার আদেশ দিয়েছেন যে আমি যেন বিপদে পাশে দাঁড়াই । আমিও উপকার করিতে পারি যদি আপনি বল! চুপচাপ রহিলাম ।আপনাকে দেয়ার মতো আমার তেমন কিছু নেই। পিছনে তাকিয়ে দেখুন! বন্ধু । দেখিলাম একটি বাছুর গরু । ভাবিলাম এই বাছুর গরুটা এখানে আসল কি করে? সাপ কহিল- এই গরুটা আপনাকে দিয়ে উপকারে আসতে চাই! এই গরুকে নিয়ে গিয়ে বড় একটি বাড়িতে রাখিবে এবং খড় কেটে ইহার ভিতরে ফেলিয়া দিবে । কিন্তু ১৫ দিবস পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত গরুকে দেখিতে পারিবে না । গাছ ছুঁড়ে ফেলার সময়েও গরুর দিকে তাকানো যাবে না । যেদিন ১৫ দিন পূর্ণ হইবে সেদিনই গরুকে দেখিতে পারিবে । কি আর করা ! অনিচ্ছা সত্ত্বেও গরুকে নিয়ে বাড়িতে গেলাম । মা বলিল - গরু পেয়েছ কোথা হইতে? মাচাং। আমার এক বন্ধু দিয়েছে । তিনি বলেছেন ছিদ্র বিহীন বড় একটি বাড়িতে গরুকে রেখে ইহাতে ১৫ দিবস খড় কেটে ফেলে দিতে হইবে । তবে ভুলক্রমে গাছ ছুঁড়ে ফেলার সময়েও গরুর দিকে তাকানো যাবে না ততদিন না ১৫ দিন পূর্ণ হইবে । তাই ! ঠিক আছে খোকা । ইহাতে প্রতিদিন খড় কেটে ফেলে দিতে লাগিলাম ।ওহ আচ্ছা! ম্যাডাম , আপনাকে বসানোর মতো আমাদের ঘরে পরিবেশ নেই । আসুন , জল পান করুন । না আরেকদিন করিব । আর আমাকে আপনি বলিও না । আমিও তোমারি বয়সী । তো আসুন না আমরা বাইরে কিছু ঘুরিয়া আছি ! যদি তোমার আপত্তি না থাকে? তোমার পরিবার আমাদের দেখিয়া ফেললে দুজনের বিপদ ঘনিয়ে আসিবে । না । কেউ দেখিবে না। চলো না ! যাওয়া যাক। তোমার কোন বান্ধবী আছে কি? কারোর সাথে তোমাদের কখনো দেখিতে পাই না যে? আমার মতো এতিম ছেলের সাথে কে বন্ধত্বের সম্পর্ক করিবে? একলা আছি । সবসময় একা থাকার চেষ্টা করিব । তাই বলিতে নেই । এতিম বলে তুমি কি মানুষ নয় ! আমি তো আছি । এখন থেকে আমি তোমার কাছের মানুষ । কথা দাও তুমিও আমার আপন হইবে। হ্যাঁ । আপন আবার কিরকম ? আমি সকলের কাছের মানুষ । তোমারও বিপদের সময় আমি সর্বদা পাশে থাকিব । আহারে বেচারী ! আপনিও যেন বুঝিতে পারো না! আচ্ছা তোমাকে কেউ কি ভালবাসে? শুধু একজন ভালবাসে । একজন! কে সেই রাজকুমারী ? আমি জানিতে পারি কি! আকাশ ভরা তারা ,তারার মাঝে আমরা । আকাশে বাতাসে যিনি ,নিঃশ্বাসেও তিনি । সে হচ্ছে আমার জন্মদাত্রী মা । তিনিই আমার সব কিছু । ওহ আচ্ছা ! আমি ভেবেছিলাম অন্য কোন মেয়ে । তুমি আমাকে ভালবাসো না? ভাসি ! সব মানুষকেই ভালবাসি । আরে ! সব মানুষের কথা বলিতেছি না । শুধু আমাকেই । তোমাকে? সেটা আবার কি রকম ভালবাসা! যে ভালবাসাতে আমরা দুজন হারিয়ে যাবো । আমি হারিয়ে গেলে মা'কে দেখাশোনা করিবে কে? আরে ! তুমি হারিয়ে যাবে কেন? তুমি তো আমার গভীর হৃদয়ে থাকিবে । এই হৃদয়ে তোমাকে আমি লুকিয়ে রাখিব । মানে! আমি কিছুই বুঝিতে পারিছি না । আমার বোকা ছেলে! আমি তোমাকে ভালবাসি । কিন্তু তোমাকে কখনো বলতে পারিনি । আজি সাগর হৃদয়ে ও পবিত্রতার সাথে বলতেছি । তোমার সম্মতি থাকলে আমরা দুজন আজি বিয়ে করিতে পারি । তুমি না করো না! বিয়ে! আমাদের বিয়ের আসর অনুষ্ঠিত হইলে আকাশ ভাঙিয়া পড়িবে । সাগরের জল শুকিয়ে যাবে । চাঁদ আকাশে না উঠে ভূমিতে উদিত হইবে । বহুদিন পর আজি কোনো বন্ধুর সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছি । আমি এখন আসি! খুমবারতি । আকাশ হইতে ভেঙে পড়িল , খুমবারতি । এই শোনো ! এমন কথা বলিতে নেই । বলো তুমি রাজি, আমি বৌ সাজি। দেখো , তোমার পরিবার আমার মতো গরীব ছেলেকে জামাই মানিতে পারিবে না আসি আমার মতো যুবতী মেয়েকে একা রেখে কেউ কি চলিয়া যায়? যাইয়ো না! যদি পরিবার আমাদের বিয়ে না মানে ইহাতে আমরা দুজন পালিয়ে যাবো । এই মেয়েটা হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নহে । এখন কি করি! এই ভাবিতেছ কি! কিছু না । সত্যি তুমি আমাকে ভালবাসো? তোমার এই মধুর বীনে কোন বিষ প্রয়োগ নেই তো! ঠিক আছে । ঘরে ফিরিতে হইবে । ঘরে ফিরে দেখি সন্ধ্যা হইলো। ইনি কে? মাচাং । চিনিতে পারিলাম না তো! মা আমার নাম খুমবারতি । এই তো দেখি স্বর্গদূত আসিয়াছে মোদের ঘরে আজি । এতো মিষ্টি মেয়ে যদি আমার বৌমা হইতো ইহাতে মাচাংয়ের জীবনটা নিশ্চয় পরিবর্তন হইয়া যেত । বেতা , রাত হইতে চলিতেছে ওনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়া এসো । মোরা একে অপরের ভালবাসি , মা । তোমারি আশীর্বাদ পেলে আমরা দুজন বিয়ে করিতে পারি । এ তো খুশির খবর । আমি কতদিন ধরে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি একটা লক্ষী মেয়ে আমার ছেলের বউ হইয়া আসিবে । আমাদের দোয়া করবেন , মা । মায়ের পায়ের ধুলো নিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন । নতুন বৌ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠিয়াছে । তৈসা হইতে স্নান করিয়া আসিল । এদিকে মাচাংয়ের ঘুম ভাঙ্গার খবর নেই । বৌয়ের গ্লাস জল ছিটানোতেই ঘুম ভাঙিল । এতক্ষণ ঘুমালে বাড়ির কাজ দেখিবে কে মাচাং সাহেব? মাচাং মিট মিট করিয়া চোখ খুলিল । আচ্ছা পিছনে যে মস্তক ঘরে কে থাকে ? কে আর থাকিবে ! ওখানে একটি গরু রাখা আছে । ওহ আজকে পনেরো দিবস পূর্ণ হইয়াছে । মোর মনেই ছিলনা । ভুলিয়া গিয়াছিলাম গরুকে দেখিতে । কি ? গরু রাখা আছে! আমি তো ৩ দিন পূর্বে দেখিলাম ঘরটি হীরা ভরে গিয়াছে । হীরা! হীরা আসিল কোথা হইতে? দেখিতে হইবে । একি ! সত্যি । তুমি ঠিক বলেছিস । মাচাং এই হীরা গুলো মাটিতে গর্ত খুঁড়ে রাখিতে হইবে । ইহাকে আমার মতো যদি কেহ দেখিয়া ফেললে মোদের সর্বনাশ হইবে । অবুঝ ছেলে বৌয়ের কথা শুনিতে হইবে । জঙ্গলে গর্তের ভিতর হীরা গুলো পুঁতে রাখিল । কিছু হীরা হাতে রাখিল । আমি পঞ্চাশটি হীরা নিয়ে বাজারে বিক্রি করতে যাচ্ছি । খুমবারতি এই হীরা গুলো কি বিক্রি করিতে পারে? হ্যাঁ। হীরা গুলো বিক্রি করিয়া দুপুরে ঘরে ফিরলাম । ব্যাগ ভর্তি টাকা ! খুমবারতি। এই টাকা গুলো তুই পেলি কোথায়? বাজার থেকে চুরি করনি তো! না । হীরা গুলো বিক্রি করিয়া টাকা পাইয়াছি । এবার মোদের ঘরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হইবে । আমরা নতুন একটি পাকা বাড়ি তৈরি করিবো । ইহাতে মোরা দুজন ও শ্বাশুড়ি মা সুখে , শান্তিতে বসবাস করিব - মোরা সদা হৃদয়ে ঠাঁই দিও আজি, তোমারি বুকে থাকিব আমি বৌ সাজি। নাহি থাকুক সম্পদ - ধন , তুমিই জগতের হীরের টুকরো মোর আপনজন