ত্রিপুরা মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য দীঘিনালার মায়িনী নদীর তীরে দু’বছর নির্বাসন জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। একদিন নক্ষত্র নারায়ণ দূত পাঠিয়ে জানিয়ে দেন যে, আপনি যেখানে (দীঘিনালা) নির্বাসন জীবন কাটাচ্ছেন এ অঞ্চলটি ত্রিপুরা রাজ্যভূক্ত। কাজেই গোবিন্দ মাণিক্য যেন ত্রিপুরা রাজ্য ত্যাগ করে অন্যত্র গিয়ে জীবন যাপন করে। এ আদেশে গোবিন্দ মাণিক্য দীঘিনালা ত্যাগ করে তৎকালীন আরাকান রাজ্যভূক্ত রামুতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহন করেন। জানা যায়, দীঘিনালা থেকে রামুতে যাবার প্রাক্কালে খাগড়াছড়ির আলুটিলা পর্বত শ্রেণিতে বসবাসকারী ত্রিপুরা জনগণ গোবিন্দ মাণিক্যের রাত যাপনার্থে একটি বাঁশের কেল্লা। নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। ত্রিপুরা ভাষায় বাঁশের কেল্লার নাম হয় “আকবাড়ী”। এই আকবাড়ীটিই আলুটিলারপূর্ব নাম। বর্তমানকালেও আলুটিলা পর্বত শ্রেণিতে আকবাড়ী নামে একটি গ্রাম রয়েছে। ত্রিপুরা মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য যে সময়ে আলুটিলা পর্বত শ্রেণিতে। রাতযাপন করেছিলেন তখন ছিল ফাল্গুন মাসের শিব চতুর্দশীর তিথি। শিবভক্ত মহারাজা শিব পূজা করার জন্য একটি জলাশয় বা স্রোতস্বিনী নদীর সন্ধান করলে তখন ত্রিপুরা জনগণ মহারাজাকে বলেন যে, নুনছড়ির পশ্চিম পর্বতের উপর একটি সুপরিসর জলাশয় আছে। তখন ত্রিপুরা মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য উক্ত পর্বতষ্ঠিত জলাশয়ে গিয় শিবপূজা করেন এবং পূজা শেষ করার পর উক্ত জলাশয়ে শিবাল বিসর্জন দেন। তখন থেকে উক্ত জলাশয়ের নামকরণ হয়েছিল মাতাই পুত্থান। যা বাংলা ভাষায় দেবতা পুকুর নামে সমধিক পরিচিত। মাতাই পুখিরি বা নুনছড়ির দেবতা পুকুর ত্রিপুরাদের স্বকীয় মণ্ডিত একটি তীর্থক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত ত্রিপুরা মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্যই এই তীর্থক্ষেত্রের প্রবর্তক। অতপর ত্রিপুরা মহারাজা রামুতে তিন বছর নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সেখানে তাঁর নির্বাসন জীবনকালে বাংলার নবাব শাহসুজা দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে আরাকান যাবার পথে গোবিন্দ মাণিক্যের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। এই শাহসুজাই মহারাজা গোবিন্দ - মাণিক্যকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য নক্ষত্র নারায়ণকে সামরিক সাহায্য প্রদান প্রদান করেছিলেন। ভারত উপমহাদেশে ত্রিপুরা নামে একটি প্রাচীনতম জনজাতির ১৮৪ জন রাজন্যবর্গের মধ্যে যে মহারাজা রাজর্ষি নামে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনিই মহারাজা গােবিন্দ মাণিক্য। ত্রিপুরা রাজন্যবর্গ বংশ তালিকা অনুযায়ী গােবিন্দ মাণিক্য ১৬৩তম মহারাজা। মহারাজা গােবিন্দ মাণিক্য ১০৭০ ত্রিপুরাব্দে অর্থাৎ ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ্যের সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন। বিশ্ব কবি। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর মহারাজা গােবিন্দ মাণিক্যকে কেন্দ্র করে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এ দুটি গ্রন্থের নাম “রাজর্ষি ও বিসর্জন”। উল্লেখিত দুটি গ্রন্থে রবীন্দ। নাথ ঠাকুর ত্রিপুরা মহারাজা গােবিন্দ মাণিক্যের মানবিক গুণ, দয়া, ত্যাগ, দেবভক্তি ও মহত্ত্বের কথা এবং সিংহাসন ত্যাগ করে নির্বাসনে যাবার কথা। বিস্ততভাবে বর্ণনা করেছিলেন। ত্রিপুরা মহারাজা গােবিন্দ মাণিক্য তাঁর রাজত্বকালে বৈমাত্রেয় ভাই নক্ষত্র নারায়ণকে বঙ্গদেশে রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। নক্ষত্র নারায়ণ ছিলেন। অতিশয় ধূর্ত ও ক্ষমতা লােভী। বঙ্গের রাজ দরবারে বসে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। মহারাজা গােবিন্দ মাণিক্যকে কীভাবে সিংহাসন থেকে উৎখাত করা যায়। কিন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সামরিক বাহিনী ছিল মহারাজা গােবিন্দ মাণিক্যের অনুগত। কাজেই বড় ভাইকে সহজে উৎখাত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নক্ষত্র নারায়ণ। বাংলার নবাবের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তখন বাংলার নবা। ছিলেন দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের বড় ভাই শাহ সুজা। নবাব শাহ সুজারও লােভ ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের হস্তী সম্পদের প্রতি। তাছাড়া চট্টগ্রাম দখল করে নেয়ারও তার অভিপ্রায় ছিল। এক্ষণে নক্ষত্র নারায়ণের প্রস্তাব নবাব লুফে নিলেন। নবাব শর্ত দিলেন এই মর্মে যে, মােগল সৈন্য গােবিন্দ মাণিক্যকে হটিয়ে ত্রিপুরা সিংহাসনে নক্ষত্র নারায়ণকে বসাবে, তার বিনিময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলকে নবাবের হাতে তুলে দিতে হবে। বাংলার নবাবের শর্তে নক্ষত্র নারায়ণ রাজী হয়েছিলেন।