মৃদু হাওয়ায় কাশফুল রাশি রাশি ফুটছে শরৎতের ঋতুতে। সুনীল আকাশে কোথাও নেই ঘন কালো মেঘের কণা। সাম্পারি, বকুল ফুলের গন্ধে প্রভাতকে করে তোলে চির আনন্দদায়ক। রোজ মাইনী নদীতে নৌকা বেয়ে দুই জমিদার পুত্র মাইতাং , মোহনের খেলা খেলি। বিদ্যাপীঠে যাওয়া , খেলাধুলা, গোসল, আহার ইত্যাদি সব কিছুতেই নেই তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি। দেখলে মনে হয় তাদের সম্পর্কটা এসেছে যেন আশীর্বাদ রূপে স্বর্গ থেকে।
চুমুই : মানিক যাচ্ছ কোথায়?
মানিক: জমিতে ( ধান খেতে) যাবো। অনেক দিন হয়েছে জমিতে যাওয়া হয়নি। তিন সপ্তাহের আগে জমি দেখতে গিয়েছিলাম। দুয়েকটা ধান পাতা পঁচা রোগ পড়েছিল তখন থেকে আর জমিতে যাওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম আজ গিয়ে দেখি।
চুমুই : ওহ আচ্ছা! সাহেব ফেরার সময় মনে করে আমি বাড়িতে এসো , কিছু কথা আছে।
মানিক : ( মাথা নেড়ে) ঠিক আছে। (জমির উদ্দেশ্যে রওনা হইলো) আসবো।
চুমুই : মাইতাংয়ের মা ( স্ত্রী শশী)?
শশী : বলেন জনাব ( হেসে)।
চুমুই : কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখতে পাচ্ছো কি! মুখে আহার না দিয়ে সকালেও কাজ করেছি। এবার খেতে দিবে তো!
শশী : দিচ্ছি জনাব দিচ্ছি! ( ঘরে প্রবেশ করল , খাবার টেবিলে বসতে বললেন স্বামীকে)
চুমুই : মাইতাং ( ছেলে) কোথায়? তাকে দেখতে পাচ্ছি না যে! টেবিলে বসতে বলো একসাথে খাবো।
শশী : খোকাকে খুঁজতে যাও কেন? সে কি লক্ষী সোনার ছেলের মতো বাড়িতে বসে থাকে? কখন ভোর হবে আর বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে সেসব ভাবতে ভাবতে তার সুনিদ্রা হয় না। কোথায় আর যাবে ! হয়তো যোহনের সাথে নদীতে যেতে পারে!
চুমুই : ( দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে) হ্যাঁ। তাই তো ! এই বয়সে বন্ধু-বান্ধীদের সাথে মিশবে তা স্বাভাবিক তাই বলে মাত্রাতিরিক্ত মিশতে হবে সেটা কিন্তু অনুচিত। আমরাও এই বয়সটা পার করেছি। সেই সময় আমরা পিতা মাতার অবাধ্য হয়নি।
শশী : এখন ওসব কথা রেখে খাওয়া শুরু করি। ছেলে বাড়িতে ফিরলে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন।
মাইতাং : বন্ধু ( যোহন) , এই নদীটি কি অপরূপ মায়াবী তাই না! মেরুং এলাকাবাসীদের অবিরল বর দেয়।
যোহন : হ্যাঁ। নদীসহ যেন আমরা তিন বন্ধু ( হো হো করে হেঁসে)। তাই তো রোজ বিকেলে এই নদীতে এসে আমাদের খেলা করতে হয়। নীল আকাশের মেঘেরা সায়া দিয়ে রাখে যা আমাদের অসুবিধাই হয় না।
মাইতাং : সত্যিই আনন্দে আমার তো গান গাইতে ইচ্ছে করতেছে।
যোহন : ( হা হা হা হেসে) তাই ! এই শন শন শুকনো হাওয়ায় আর তোমারি মধুর স্বর গান শুনতে ইচ্ছে করতেছে।
মাইতাং : ( গান গাইতে লাগলো) আহা! কি সুন্দর মোদের রঙিন তরী,
ভালবাসি বলিয়া আমি মরে যেতে পারি।
রানী সাজিয়েছে তরী সুন্দর মোহনা,
যদি বলে পারি পড়াতে হৃদয় গহনা,
দিও সাথী ভালবাসা,
আমায় কাঁদায়ো না।
যোহন: দারুন! গানটি খুব সুন্দর হয়েছে। এই দেখ মাইতাং , কি সুন্দর একটি লঞ্চ যাচ্ছে। ( হেসে) মনে হচ্ছে যেন আমার শ্বশুর মশাইয়ের লঞ্চটি চলে যাচ্ছে।
মাইতাং : তাই ! ( হেসে) ঠিক বলেছ। এবার আসা যাক ! খিদে পেট চোঁ চোঁ করছে। সকাল থেকে কিছুই খাইনি।
যোহন : তাই !
মাইতাং : হ্যাঁ । বাড়িতে যেতে হবে , না হয় মা বকা দিবে।
যোহন : ঠিক আছে ( নৌকা থেকে নেমে আসলো)।
মানিক : ( চুমুইদের বাড়িতে) বাড়িতে কেউ কি আছেন?
শশী : হ্যাঁ , আসুন । ( মাথার ঘোমটা ঠিক করে বেরিয়ে এলো)
মানিক : দাদা কি বাড়িতে আসে?
শশী : ( মাথা নেড়ে) হ্যাঁ , ভিতরে আসুন , আপনি!
চুমুই : জমিদার সাহেব সেই কখন থেকে আপনার জন্য বসে আছি !
বেপার টা হলো আমাদের মাইতাং এবং যোহনকে নিয়ে। তাদের সারাদিন ঘুরাঘুরি পরিবারে এবং সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে!
মানিক : ঠিক বলেছেন। ভালো পড়াশোনার জন্য শহরের একটি মানসম্মত কলেজে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ছেলে তাতেই কিছুই সম্মতি দেইনি। এই ছেলেকে কি করে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তুলতে পারবো এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। অবশ্যই ছেলে পড়াশোনায় মন্দ নয়। কিন্তু পাড়ার প্রতিবেশী খারাপ বন্ধুদের সাথে মেলামেশা, নিজের প্রতি সময় না দেওয়া যা আমাদের ভাবনার বিষয় করে তুলেছে।
চুমুই : ( এক গ্লাস পানি খেয়ে) হ্যাঁ। আমিও সেটাই ভাবছি। অবশ্যই সন্তানের বুঝার উচিত কোনো পিতামাতা সন্তানের অমঙ্গল চাই না।
মানিক: এ বিষয়ে আমিও দেখছি। কি করা যায়। আজ আছি , ধন্যবাদ।
চুমুই: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মাইতাং : ( একা নদীর পাড়ে) অনেক দিন হয়েছে যোহনের দেখা নেই। ( মন খারাপ অবস্থায়) কি ব্যাপার ? ( একা একা নৌকায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে)
মানিক: বাবা যোহন , কি ব্যাপার ? তুমি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছো না, সব ঠিক আছে তো?
যোহন : ( মাথা নেড়ে)
মানিক: দেখ ছেলে আমার , আমার কিছু মন্দ কথায় মন খারাপ , রাগ করতে নেই। তুমি বড় হয়েছ, তোমার এখন বোঝার বয়স এবং সময় হয়েছে। তোমাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তোমার সামনে তাকিয়ে দেখ , তোমার সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে। তোমাকে এই বয়সের পরীক্ষায় তোমাকে দর হতে হবে । এখন যাও । হাত মুখ ধুয়ে খেতে টেবিলে আয়। বেলা অন্যান্য হয়েছে।
যোহন: ( শুকনো মুখে) ঠিক আছে , বাবা। ( মনে মনে বলি খাবার শেষ করে মাইতাংয়ের খোঁজে বের হতে হবে)
মাইতাং: ( মন খারাপ) একা একা বসে আছে নৌকায়। ( হঠাৎ দেখতে পেল একটি লঞ্চ তার দিকে আসছে। নৌকার সামনে এসে লঞ্চটি থামলো। মাইনী নদী থেকে একটি পদ্মফুল তুলে কান, দাঁতে, বুকে, কপালে লাগিয়ে পরে ফুলটি নদীতে ভাসিয়ে দিল )। কি অদ্ভুত? কে এই রূপবতী মেয়েটি? আর যদি যোহন আমার সাথে থাকতো অবশ্যই বিষয়টি সে আমাকে পরিষ্কার করে দিত। মোর প্রাণের প্রিয় বন্ধু ,
তোমারি দেখা পাবো কি আর বন্ধু? ( ভাবতে ভাবতে নৌকার ঘুমিয়ে পড়িল। হঠাৎ যোহনের ডাক শুনতে পেলেন। মনে মনে বললো ; কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো?
যোহন: সুপ্রভাত, বন্ধু! ( খুশিতে হেসে)
মাইতাং: ( তাড়াহুড়ো করে উঠলো) কে কে চিৎকার করে উঠল!
যোহন : দূর! আমি । তাই শুয়ে শুয়ে কি ভাবছিলেন এতক্ষণ?
মাইতাং : সুপ্রভাত! আর বলিও না।য একটু আগে উপর ই একটি লঞ্চ এসে আমার সামনে থামলো। লঞ্চ থেকে একটি রূপসী কন্যা ( সুন্দরী রমণী) বেড়িয়ে এসে নদী থেকে একটি পদ্মফুল তুলে কান, দাঁতে, বুকে, কপালে দেয়ার পর পানিতে ভাসিয়ে দিল। তারপর লঞ্চটি চলে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কিছুই বুঝতে পারলাম না। এ আমি কি দেখতে পেলাম ? তোমার পায়ে পড়ি , বন্ধু ; বিষয়টি আমাকে বুঝিয়ে দিন।
যোহন: ( হা হা হা হেসে) আহারে! পায়ে পড়তে হবে না। ভেবে দেখি কি ছিল সেগুলি।
মাইতাং: ঐ ছায়া হরিণীর দেখা না পেলে আমি বাঁচতে চাই না, বন্ধু। কিছু একটা করো !
যোহন: ( নৌকায় উঠে দাঁড়ালো) এটি খুব স্বাভাবিক বিষয়। বুঝতে কি আর বাকি থাকে? এতক্ষণে তোমার বুঝতে পারার কথা ছিল । মেয়েটি কেন কেন পদ্মফুল হাতে নিয়েছে ; তার নাম হচ্ছে পদ্মাবতী। মাইতাং: ( অবাক হয়ে তাকিয়ে) তাই!
যোহন: হ্যাঁ। তিনি কেন ফুলটি দাঁতে লাগালেন _ তার বাবার নাম দন্ত কুমার। কেন ফুলটি কানে লাগালেন- তাদের বাড়ি কর্ণফুলীতে। কেন বুকে এবং কপালে ফুলটি লাগালেন তার হচ্ছে ভালবাসলে তাকে খুঁজতে যেতে, নিয়তির লেখা থাকলে তোদের বন্ধন হবে।
মাইতাং: অদ্ভুত তো! তুমি কি তার সম্পর্কে কি করে জান ?
যোহন: ( মাথা নেড়ে) হ্যাঁ।
মাইতাং: আর দেরি কর না , বন্ধু। তাকে খুঁজে বের করতে হবে।
যোহন: তুমি পৌঁছাতে পারবে তো তার কাছে?
মাইতাং: কেন? তোমার মতো বন্ধু পাশে থাকলে আমি পৃথিবীর সব। মেয়ের কাছে পৌঁছাতে পারি।
যোহন : তাই! ভাবতে ভাবতে হবে। কি করা যায়। খুব সাবধানে পদ্মাবতীদের গ্রামে যেতে হবে।
মাইতাং: কেন? যোহন: পদ্মাবতীর বাবা গ্রামের মুরব্বী।
আমরা তার মেয়ের খুঁজে বেরিয়েছি জানতে পারলে না আমাদের কেঁটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিবে।
মাইতাং: বলো কি!
যোহন: হ্যাঁ। তবে বাড়ি থেকে আমরা কি করে বের হবো ? বাবা মা কি আমাদের যেতে দিবে?
মাইতাং: ( একটি বট গাছের নিচে বসলো) হ্যাঁ। ঠিক বলেছিস। বন্ধু (যোহন) একটি উপায় বের কর! যাতে করে আমরা পদ্মাবতীর কাছে পৌঁছাতে পারি।
যোহন: তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি , বন্ধু। এখন লক্ষী ছেলের মতো বাড়িতে গিয়ে অর্থ মজুদ করতে থাকেন। অর্থ মজুদ করতে পারলে কাল পরশু কর্ণফুলী উদ্দেশ্যে রওনা হইবো। তবে খুব সতর্কতার সঙ্গে বাড়ি থেকে টাকা চাইতে হবে যাহাতে তারা বুঝতে না পারে আমরা কি করতে যাচ্ছি।
মাইতাং: ( মাথা নেড়ে) তুমি চিন্তা করো না। আমি সবকিছু ব্যবস্থা করবো। তুমিও আমাকে কিছু মুদ্রা সংগ্রহে সাহায্য করিছ , বন্ধু।
যোহন: (মাথা নেড়ে) আজকে মতো আসি।
মাইতাং: ( মাথা নেড়ে) ঠিক আছে।
শশী: কোথায় ছিলে? পুত্র সারাদিন এতো ঘুরাঘুরি না করলে কি হয় না? বয়স আঠারো পার হতে চলেছে বাচ্চাদের মতো সারাদিন ঘুরাঘুরি করলে গ্রামের লোকজন খারাপ দৃষ্টিতে দেখবে তো। তোর আব্বু বলেছে কাল তুমি এবং তোর আব্বু দাদির বাড়িতে বেড়াতে যাবে।
মাইতাং: তা ঠিক , আম্মু না। আমি আব্বুর সঙ্গে দাদির বাড়িতে যেতে পারবোনা কেননা কাল আমার এক বন্ধুর বিয়ে ( কর্ণফুলীতে) । তিনি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং তাদের বাড়িতে কিছু দিন থাকতে বলেছে । তুমি না করো না , মা। ফিরে এসে দাদির বাড়িতে যাবো।
শশী: তোমার বাবা কি তোমাকে যেতে দিবে?
মাইতাং: মা, বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলুন না! আর কিছু খরচা টাকাও লাগবে।
শশী: ঠিক আছে। বলে দেখি। সে কি বলে! ( বলতে স্বামীর কাছে গেলেন) তুমি বলছিলে আগামীকাল মায়ের ( শ্বাশুড়ি) বাড়িতে যাচ্ছো কিন্তু মাইতাংকে এক বন্ধু তার বিয়ের নিমন্ত্রণ দেওয়ায় সে ওখানেই যাবে বলছেন।
চুমুই: বলো কি! তাহলে সে কি যাবে না আমার সাথে?
শশী: না । সেখান থেকে ফিরেই তার দাদির বাড়িতে বেড়াতে যাবে বলছিল।
চুমুই: ও আচ্ছা।
শশী: ( মাথা নেড়ে) আর খরচ হিসেবে কিছু টাকা চেয়েছে।
চুমুই: কেন গতসপ্তাহে যে টাকা দিয়েছিলাম সে ওগুলো কি করেছে? ( পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বের করল) এই মুহূর্তে বেশি টাকা নেই । মাত্র দশ হাজার টাকা আছে। এগুলো নাও , আর ছেলেকে জিজ্ঞেস কর কত টাকা লাগবে?
শশী: (মাথা নাড়ল এবং ছেলেকে ডাকল) তোমার কত টাকা খরচা লাগবে?
মাইতাং: পনরো-বিশ হাজার টাকা হলেই চলবে,মা।
শশী: ( ছেলের কান ধরে) এতো টাকা তুমি কি করবে বুঝতে পারছি না! অর্থ বিলাসীতা করতে নেই , পুত্র।
যোহন: ( ভোর সকালে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে নৌকায় বসে আছে) বন্ধু কখন আসবে? এতো দেরি হচ্ছে কেন?
মাইতাং: এসে গেছি। ( বস্ত্র ও খাদ্য দেখে) এতো আয়োজন! সত্যি তোমার মতো বন্ধু পেয়ে আমি ধন্য।
যোহন: তোমার অবস্থায় কেমন? বাড়ির সব কাজ সেরে এসেছেন তো! মাইতাং: ( মাথা নেড়ে) হ্যাঁ।
যোহন: এই তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠ। কেউ দেখে ফেললে আমাদের অবস্থা খারাপ হবে।
মাইতাং: ( উঠলো , ইঞ্জিন চালিত নৌকায়) চলো।
আমার ময়না পাখি রে খুঁজি,
চলে আসতেছি মোরা দূই বন্ধু আজি,
ওগো, থেকো তুমি রূপালী সাজি,
তোমার স্বপ্নে আমি আসি।
পৌছাইতেছি মোরা প্রেমের ঘাটে,
বাড়িয়ে দিও তোমার সোনার হাতে। ( হা হা হা)
যোহন: তুমি যা শুরু করেছ না একেবারে মাঝিদেরকেও হার মানলেন। তোমার এই গান পদ্মাবতী শুনলে পোষা পাখির মতো তোমার হাতে ধরা দেবে। ( দুজনে হাসতে লাগল)
মাইতাং: আচ্ছা বন্ধু! এখন কর্ণফুলীতে পদ্মাবতীদের বাড়িটি কোথায়?
যোহন: তুমি চিন্তা করো না। ওসব আমাকে ভাবতে দাও।
মাইতাং: ( দুগালে চিমটি দিয়ে) এই না হয় তুমি আমার বন্ধু। উহ সূর্যাস্তের সময় হইয়াছে। আমরা ঘুমবো কোথায় ?
যোহন: কেন? এই যে শ্বশুর বাড়ি আছে না মানে নৌকা তো আসেই , এখানেই ঘুমাবো।
মাইতাং: কি যে বলো না তুমি! ঘুমাতে তো হবেই এ নৌকায় হলেও। ভালোই তো খোলা আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে দুই বন্ধু আকাশের তারা গুনতে পারবো। রাত্রি শেষে শুকতারার সাথে কথা বলবো তারা যেন আমাদের পদ্মাবতীর বাড়ির ঠিকানা বলে দেয়।
যোহন: গুড আইব। কি খাবেন বলো?
মাইতাং: ক্ষুধা নেই রে বন্ধু। এ সময়ে শুধু পদ্মাবতীর চাঁদের মতো সুন্দর মুখটা চোখে ভেসে ওঠে।
যোহন: প্রেমের জ্বরে কেঁপে মরিও না তো! নে খাও। ( দুজনে খেতে লাগল কলা, রুটি, ডিম, কমলা)
মাইতাং: ( খাবার খেতে খেতে) এই দেখ , আমরা কোথায় এসে পড়েছি! মনে হচ্ছে এটি কোনো নদী বন্দর। যোহন: ভালোই হয়েছে। নৌকাটি এখানেই থামাও। কাল ভোরে আবার রওনা দেবো। ( নৌকায় দুজনে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়িল)
মাইতাং: ( মিট মিট করে চোখ মেলে) খুব ভালো ঘুম হয়েছে। এই যোহন?
যোহন: ( উঠে পড়ল)
মাইতাং: তাড়াতাড়ি উঠ। আবার যেতে হবে। সূর্য উঠেছে।
যোহন: নৌকাটি ছেড়ে দাও।
মাইতাং: ( নৌকাটি চালালেন, দুজনে চুপচাপ। পৌঁছল কর্ণফুলী নদীতে)
যোহন: নৌকাটি এখানেই থামাও। ( নৌকাটি থামাল , দুজনে নৌকা থেকে নামল) এবার যাওয়া যাক!
মাইতাং: আমি তো রাস্তা চিনি না।
যোহন: আমার সাথে হাঁটতে থাক। ( গিয়ে পৌঁছলো পদ্মাবতীদের গ্রামে। কিন্তু সরাসরি পদ্মাবতীর সাথে দেখা করা যাবেনা। পৌঁছাতে দেখতে পেল বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। বাড়িতে গিয়ে ডাকলো ! পরিচয় নিয়ে জানতে পারল মহিলাটির নাম জাহলী )
জাহলী : ( দরজা খুলে) কেদা?
যোহন: দাদিমা আমরা।
জাহলী : ও মোর ঘরে চাও কি! এ হৃদয়খানি ছাড়া মোর ঘরে কিছুই নাই , বাবা।
যোহন: তেমন কিছু না দাদিমা। আমরা দুজন ভ্রমণে বেরিয়েছি , আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা কয়েকদিন আপনার বাড়িতে থাকবো।
জাহলী: মাশাল্লাহ , এ তো খুশির খবর। কোন সমস্যা হইবে না , যত খুশি থাকতে পারো। ( বুড়ি তাদের দুজনকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেলেন) আসুন , বসুন।
মাইতাং: দাদিমা , আপনি কি একা ? কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে !
জাহলী: হে কথা কি আর বলবো দাদুভাই! মোর লগে কেউ থাহে না।
যোহন : দাদি তো আপনার সংসার চলে কিভাবে?
জাহলী: ( অশ্রু মুছে) পদ্মাবতীগোর বাড়িতে কাজ কইরা খাই। রোজ পদ্মাবতীরে তাদের ফুল কানন থেইকা মালা গেঁথে নিয়া যাইতে হয়। মালা গাঁথা সুন্দর হইলে সছ মোরে কিছু ট্যাকা বকশিশ দেয়।
যোহন: ( মনে মনে বলি ও আচ্ছা , দাদিমাকে দিয়ে কাজ সেরে ফেলতে হবে ) ও আচ্ছা।
জাহলী: রাত হইতে চলিতেছে , খাইতে হইবে। তোরা হাত মুখ ধুয়ে খেতে আইসো।
মাইতাং: বন্ধু উদ্দেশ্য সফল হতে চলেছি আমরা।
যোহন: ( মাথা নেড়ে, হাত মুখ ধুয়ে খেতে চলো। খেতে বসে বুড়িকে খাইয়ে দিয়েছেন যোহন) খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়তে গেল। ( রোজ সকালে বুড়ি যখন ফুল তুলে মালা গাঁথতে লাগল তখন যোহন বুড়ির হাত থেকে মালাটি নিয়ে সে সুন্দর করে গেঁথে দিলেন এবং ঝুড়িতে মালার সাথে একখান চিঠি পাঠালেন । )
জাহলী: কুমারী মা ( পদ্মাবতী) তোর লাইগা মালা নিয়া আইছি।
পদ্মাবতী: ( হাতে নিল) মালার সাথে একটা চিঠি( বুড়ি ওটা কি কাগজের টুকরা ) পেল। ( চিঠিটা লেখা ছিল আমি এসে গেছি যাকে তুমি মাইনী নদীতে পদ্মফুল ফুল তুলে কাহিনী করেছিলেন) পড়ে ( খুশিতে) ঠাস করে গালে একটা ঠাপ্পর দিল।
জাহলী: ( বুড়ি কেঁদে কেঁদে বাড়িতে এলো) তোরা কি মালা গেঁথে দিয়েছিলে মনে হয় হের অপছন্দ হইছে।
যোহন: দাদিমা , আপনি সেটাও বুঝতে পারলেন না! কেন চড় মারলেন? চড় মেরেছেন এজন্য যে তার মালাটি খুব পছন্দ হয়েছে।
মাইতাং: বন্ধু সত্যি বলছো তো!
যোহন: ( মাথা নেড়ে) হ্যাঁ। ( পরের দিন বুড়ির ঝুড়িতে একটি চিঠি ও একটি সুন্দর মালা পাঠালে জবাবে পদ্মাবতী একটি চিঠি ( চিঠিতে লিখেছেন ; বাবা এখন আমার বিয়ে দিবে না তাই আমি কাল পালিয়ে আসছি। তুমি আমাদের ফুল বাগানের পাশে অপেক্ষা করো আমি সেখানে আসবো )।
মাইতাং: দাদি আগামীকাল আমরা দুপুরের একটু বাজারে যাবো।
জাহলী: ( মাথা নেড়ে) ঠিক আছে।
যোহন: ( কিছু টাকা গোপনে বুড়ির বাড়িতে রেখে বাকি টাকাগুলো নিয়ে চলে গেল) মাইতাং , চলো তাড়াতাড়ি! দেরি হতে পারে! পদ্মাবতী বাগানে অপেক্ষা করবে।
মাইতাং: ( মাথা নাড়ল) হ্যাঁ। ( বাগানে পৌঁছে দেখতে পেল পদ্মাবতীকে ) ।
পদ্মাবতী: কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি আর তোমাদের পাত্তাই নেই। ( মাইতাংয়ের হাত ধরে) চলো তাড়াতাড়ি। যোহন তুমিও ওর সাথে এসেছ!
মাইতাং : ( অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল) এইতো এসেছি। হাত ধরা অবস্থায় পা চলিতে থাকল। ( নৌকায় উঠে পড়ল সকলে)
পদ্মাবতী : যোহন তুমি কেমন আছো?
যোহন: ভালো। তুমি কেমন আছো?
পদ্মাবতী: আমিও মোটামুটি ভালো। তাহলে এই রোমিও ( মাইতাং) তোমার বন্ধু তাই তো!
যোহন: ( মাথা নাড়ল)
পদ্মাবতী: এই যে রোমিও সেদিন আমার পানে হা করে তাকিয়েছ কেন ?
মাইতাং: কই না তো!
পদ্মাবতী: আমার তো দুটো কি পিছনে নাকি ? আমি দেখিনি বুঝি !
তা তুমি এতো সুন্দর মালা গাঁথতে পারো?( হেসে) আগে জানলে মালাটা তোমার গলায় ঝুলাইয়া দিতাম।
মাইতাং: আমি মালা পাঠাইনি তো ! সেটা যোহন পাঠিয়েছে।
পদ্মাবতী: ওহ বন্ধু (যোহন) তাহলে তুমিই মালাটি পাঠিয়েছিলেন। খুব সুন্দর হয়েছে , অনেক ধন্যবাদ।
আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?
মাইতাং: আমাদের বাড়িতে।
পদ্মাবতী: ( কাঁধে হাত রেখে) তাই! আচ্ছা আমাকে খুঁজে পেলে কি করে?
মাইতাং : এই বন্ধু ( যোহন) না থাকলে কি তোমাকে খুঁজে পেতাম! সে আমার পাশে আসে বলেই তো তুমিও আছো। এই বন্ধু না থাকলে হয়তো আমিও পৃথিবীতে থাকবো না।
পদ্মাবতী: তাই! তাহলে আমার কি হবে? তোমাকে ভালোবাসে আমি তো ঘরে থেকে পালিয়ে এসেছি।
মাইতাং: তুমি আমারি হবে।
পদ্মাবতী: ( খুশিতে কাজ ঘেঁষে বসল) তাই বুঝি !
মাইতাং: (মাথা নাড়ল) হ্যাঁ। ( এক রাত্রি পেরিয়ে পৌঁছলো বাড়িতে)
শশী : কতদিন হলো ছেলের দেখা নেই। কি হয়েছে ? কবে বাড়িতে ফিরবে! ( বারান্দায় বসে ভাবতে ভাবতে) আরে ! মাইতাং? ( দেখতে পেল সঙ্গে এক যুবতী মেয়ে)
মাইতাং: ( দৌড়ে গিয়ে) মাম্মি, কাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি দেখ ?
শশী: এ কে, বাবা? তোমার নাম কি? মা।
পদ্মাবতী: ( লাজুক চোখে) পদ্মাবতী।
শশী : ও গো , কে এসেছে দেখে যাও।
চুমুই: ( ছেলের কানে ধরে) আমাদের মিথ্যা কথা বলেছিলে তাই না আর এখন নতুন মানুষ ঘরে এনেছ। ( দুজনে পা ধরে সালাম করল) বেঁচে থাক বাবা বেঁচে থাক। তোমরা সুখী হউক। আজি তোমাদের বিয়ের কার্য সেরে ফেলতে চাই। কি বলো বৌমা?
পদ্মাবতী: ( হালকা মাথা নাড়ল)
চুমুই: যোহন তুমি যাচ্ছো কোথায়? তুমি এদের ( বন্ধু ও বৌ) আশীর্বাদ না করলে এরা সুখী হবে কি করে! আমার অবুঝ ছেলের পাশে থেকে তুমি যে মহৎ বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা নতুন প্রজন্মের ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে । তোমারি নিঃশ্বার্থ বন্ধুত্ব সত্যি আমাকে বিমোহিত করে।