মেঘলা হাওয়ায় , বিকেল বেলায় ; ইচ্ছে জাগে দিন দিন , প্রকৃতি বলে নিন নিন। সবাই অক্সিজেন গ্রহণ করে প্রকৃতি থেকে। গ্রীষ্মের সকাল ব্যতীত সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে দিন কাটে। কেউ গাছের তলায় , আবার কেউ বৈজ্ঞানিক ফ্যানের তলায়। খাল বিল চৌচির, সাম্পারি গাছে পাখির কিচিরমিচির।মেঘে করে না ঘুরুম , তবু কাটে না গরম। এমন সময়ে হিমাশ বলে চল , আমি বলি কোথায় যাবে বল। আমরা দু'বন্ধু হাঁটতে লাগলাম তৈসাকলক গ্রামের উদ্দেশ্যে। এই তৈসাকলক হচ্ছে পুরাতন নাম। নতুন নাম দেয়া হয়েছে লম্বাছড়া। ছড়াটি দেখতে ছোট কিন্তু লম্বা। বর্ষায় পানি বড় হয় , পানির স্থায়িত্ব কম হয়। কানাই হাতুং টিলা উঠা শেষ। জানা ছিল না এই টিলার উপরে কারোর জুম খেত আছে। হিমাশ পাহাড়ের ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম নিলেও শহুরে লেখাপড়া করায় জুম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে তার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। বলে উঠলো এ তো সমতল জমির চাষাবাদের চেয়ে টিলার জুম চাষ পদ্ধতিই ভালো। লবণ , শুঁটকি ব্যতীত হলুদ, মরিচ হরেকরকমের ধান, খুমজাইন্নি শাক , লকবানা শাক , ড্রামাই ফল ইত্যাদি পাওয়া যায়। আমি বললাম, হ্যাঁ এটাই হচ্ছে জুমিয়াদের জুম চাষের নিয়ম। এ দেখ খামচাং , ঐ ঘরটি আবার কিসের ঘর। আমি বললাম- ওটা গাইরিং ঘর। সেই গৃহে এক বছরের জন্য থাকে, অবস্থান করেই জুম চাষ ছেড়ে নেয়। চলো যাওয়া যাক গাইরিং ঘরে। পথের ওপাশ ওপাশে সোনালী রঙের ধান এবং শাক সবজি। গাইরিং ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে বন্ধু হিমাশের অবস্থা বেহাল। বাপরে বাপ! কি সুন্দর রমনী ! বাপরে বাপ! সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। মেয়েটা কোনো কিছু বোঝার আগেই একে সামলাতে হবে। না হলে এই হিমাশের জন্য যতটুকু সম্মান আছে তাও এই পাহাড়ের ঝর্নার স্রোতে মিশে কর্ণফুলীতে চলে যাবে। রাখেন তোমার বাপরে বাপ- ইয়ে মানে আমি খামচাং আর ইনি আমার বন্ধু হিমাশ। ও আচ্ছা ! মেয়েটি বলল আমি মকলতি। হিমাশ বলে উঠলো - বাপরে বাপ মকলতি! কি যেন ভাবছে । মকলতি বলে উঠলো বাপরে বাপ মকলতি মানে? মকলতি বিষয়টা খেয়াল করলো ।এবার মনে হয় বিষয়টার ব্যাখ্যা শুনতে না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না। আমি তাড়াহুড়ো করে হেসে বলে ফেললাম - ইয়ে মানে ! আসলে ও কিছু নয়। আমার বন্ধু একটু রসিক মানুষিক। কোনো কিছু দেখলে ওরকম বলে থাকে। ও আচ্ছা! আমি ভেবেছিলাম অন্য কিছু। যাক বাঁচা গেল। আমি মনে মনে বললাম এমন সুন্দরী কুমারী দেখলে কে না বলবে ; বাপরে বাপ! গায়ে পরনে নিনাই এবং রিচা। যা পরিলক্ষিত হচ্ছে খাঁটি ত্রিপুরা যুবতী মেয়ে। মকলতি বললো তা কি খাবেন বলুন? আমাদের করুন অবস্থা তো দৃশ্যমান ! যা কিছু আছে তা পরিবেশন করতে পারি ! এই বলে ড্রামাই ফল কচি কচি করে কেটে থালায় এনে দিলেন। মকলতির দেয়া ড্রামাই ফল হাতে নিয়ে খাচ্ছিলাম এমনি সময়ে হিমাশ ড্রামাই হাতে বলে উঠলো - বাপরে বাপ! কি সুন্দরী! দিলাম খোঁচা !হিমাশ বলে উঠলো তুমি আমাকে খোঁচা মারলে কেন? আরে না ! মূর্খ তাড়াতাড়ি খেতে বলছিলাম। মকলতিকে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা তোমাদের বাড়ি কোথায়? বললেন রাইন্যাপাড়ায়। এতো দূর থেকে এখানে জুম চাষ করো? তা একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে! কথা হবে! এদিকে হিমাশ কানে ফিসফিস করে বলে দোস্ত সুযোগটা হাতে নাও ,আসল কাজে নেমে যাও।না জানলে হবে বিফল,ভ্রমরের হবে সফল। সে জিজ্ঞেস করল তোমাদের বাড়ি কোথায়? এতক্ষণ ধরে মকলতির থেকে কথা শুনার আগ্রহে ছিলাম। অবশেষে তিনি কাজের কথায় আসলেন। আমার বাড়ি তৈসাকলকে আর হিমাশের বাগানবাড়ি। সে ছুটিতে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। হিমাশ বলল আমরা কবে তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবো? মকলতি বললেন এ সময় করে! আমি বললাম সত্যি তোমার পরিবেশনায় আমরা মুগ্ধ! আজ আসি! দেখা হবে। বিকেল বেলায় বাড়িতে পৌঁছে ফ্রেশ হলাম আমরা । হিমাশ জল পান করে আবারো বলে উঠলো- বাপরে বাপ! কি সুন্দর! দাদি শুনে বললেন কি ? কি কইলাম? দাদুভাই। আমি বললাম ও কিছু না , দাদি। সন্ধ্যায় আমরা পড়তে বসলাম টেবিলে। তখনও হিমাশ বলে উঠলো ; বাপরে বাপ! কি সুন্দর! এমন সময়ে ছোট বোন দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়ল। কি? কি যেন বলছিলেন হিমাশ দা? ইমি না ও কিছু না। তুই ওসব বুঝবে না। তোমার বয়স অনেক হয়েছে তাই তুমি ওসবে পা দিও না এটা হচ্ছে কচি বয়সিদের ব্যাপার । ইমি হাসলো। তাই বুঝি হিমাশ দাদা! এ বলে রুম থেকে চলে গেল। আমি হিমাশকে বললাম - তোমার মাথা ঠিক আছে! এই কখন থেকেই বলেই যাচ্ছো বাপরে বাপ! বাপরে বাপ! হিমাশ উত্তর দিল , তো কি করবো? এক কাজ কর দোকান থেকে একটা সুপার ঘাম কিনে নিয়ে আসো। ওটা কি করবে আবার? মুখে দেব। খামচাং তুই কি জানিস ঐ মকলতি কতো সুন্দরী? আমার জীবনেও ওর চেয়ে সুন্দরী মেয়ে দেখি নাই। আচ্ছা তুমি বলো তো আমাদের ত্রিপুরা মেয়ে এতো সুন্দরী হয় ? সে তো মেয়ে নয় পরী ! তুমিই বলো আমার কি বা করার আছে , বাপরে বাপ ছাড়া আর কিছু বলার আছে?মকলতিকে দেখার পর থেকে হিমাশের মন খারাপ । সন্ধ্যায় মা , ছোট বোন ইমি , দাদি আহারের জন্য ডাইনিং টেবিলে বসলাম। এমন সময়ে হিমাশ বলে উঠলো- বাপরে বাপ। বাড়ির লোকেরা সবাই অবাক! ইমি চোখ মেরে হিমাশকে বললেন কি ব্যাপার দাদাভাই ! সেই কখন থেকে শুনে আসছি বাপরে বাপ , বাপরে বাপ। শব্দটা মনে হয় আমার কাছে নতুন লাগছে , এর আগে কখনো শুনিনি। আমি বললাম , ইয়ে মানে কিছু না। আসলেই ও দুপুরে ঘুরতে যাওয়ার সময় একটা সুন্দর ময়না পাখি দেখেছিল। পাখিটি র অতি সৌন্দর্যের জন্য সে তখন থেকেই ওসব বলে আসছে। হিমাশ আমার দিকে আমতা আমতা করে তাকালো। মা বললো ও তাই ।শহরে বড়ো হয়েছে গ্রামীণ পরিবেশটা নতুন লাগবে এ স্বাভাবিক। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে গেলাম আমরা। হিমাশের কন্ঠে বাধা নেই ; বাপরে বাপ! আমি হেসে বললাম হয়েছে তো ঘুমাতে পারি। এভাবে চলতে থাকে কিছু মাস , দিন , হিমাশও থেকে গেল দিন দিন। দুই বন্ধু একসাথে হলে যেমনি পৃথিবীতাকে ভুলে যাই ,তেমনি মকলতির খোঁজ নাই। দুই বন্ধু মিলে ঘুরতে , জমিয়ে ফুর্তি করতে থাকি। এভাবে চার - পাঁচ মাস চলে গেল,মকলতির কথা মনে পড়ল। শরৎ কালের মাস। দুই বন্ধু চলতে লাগলাম মকলতির খোঁজে। মকলতির ভাস্য অনুযায়ী গ্রামে প্রবেশ করে প্রথম যে বাড়িটি চোখে পড়ে সেটা তাদের। হিমাশ বাড়ি অচেনার মানুষ নয়। গ্রামে পৌঁছে বাড়ির সামনে দাঁড়াতে চল্লিশ বছরের বয়স্ক পুরুষ বেড়িয়ে এলো। সম্ভবত ওনার পিতা ।আমি বললাম এটা কি মকলতির বাসা। তিনি বিনা সংকোচে বললেন হ্যাঁ। ঠিক চিনতে পারলাম না! আমরা মকলতির ........আমার মেয়ে মকলতির তো বিয়ে হয়ে গেছে ! তোমরা কি সেই খামচাং , হিমাশ ? আমি বললাম আপনি ঠিক বলেছেন। মকলতি তোমাদের কথায় বলেছিল। আমরা তার বিয়ে ঠিক করলে সে বাধা দেয়। বলছিল তার পছন্দের ছেলে আছে হিমাশ , খামচাং নামে দুই ছেলে। আর তোমাদের জন্য সে কয়েক মাস অপেক্ষাও করেছিলেন কিন্তু অনুপস্থিতের জন্য পরে বিয়েতে সম্মতি প্রকাশ করেন। মকলতিকে হিমাশের মতো আমাকেও বলতে হয় - হায় রে বাপরে বাপ।